শ্রমিকের অধিকার, বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ : মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশিত: ৬:০২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩০, ২০২৫

কাঞ্চন কুমার ঘোষ (অভি)
১লা মে, আন্তর্জাতিক মে দিবস, পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং অধিকারের ইতিহাসের এক অনন্য স্মারক। ১৮৮৬ সালের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তা কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতিফলনেই আজকের শ্রমিকদের অধিকার সচেতনতা ও আইনি সুরক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠেছে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন থেকেই যায় — শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার কি আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
শ্রমিকের অধিকার: সংগ্রামের প্রেক্ষাপট
শ্রমিকের অধিকার বলতে বোঝায় ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা, কর্মঘণ্টার নির্দিষ্ট সীমা, সংগঠিত হবার স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত মর্যাদার নিশ্চয়তা। এগুলি শুধু মৌলিক মানবাধিকার নয়, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। বিশ্বের বহু দেশে শ্রম আইন ও নীতিমালায় এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো বড় ফাঁক রয়ে গেছে।
বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিম্ন মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম ও জেন্ডার বৈষম্য এখনো শ্রমিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকের দাবি আদায়ের চেষ্টাকে দমন করা হয় আইনগত বাধা, বা কখনো কখনো সহিংস পন্থায়।
বর্তমান পরিস্থিতি: সংকট ও সম্ভাবনা বর্তমানে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, বিশ্বায়নের বিস্তার এবং করোনা মহামারির অভিঘাতে শ্রমবাজার এক গভীর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
কিছু চিত্র তুলে ধরা যাক:
অনিরাপদ কর্মসংস্থান: অনানুষ্ঠানিক খাতে (informal sector) কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ৮৫% শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত, যেখানে শ্রমিক সুরক্ষা কার্যত নেই।
ডিজিটাল বৈষম্য: প্রযুক্তি নির্ভর কাজের চাহিদা বাড়লেও, সাধারণ শ্রমিকরা সেই সুযোগ থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। নতুন ধরনের স্কিলের অভাব তাঁদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন ও শ্রম শোষণ: আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফলে উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকরা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়েছেন। কম মজুরিতে অধিক উৎপাদনের দাবিতে তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
নারী শ্রমিকদের অবস্থা: নারী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা এবং যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাঁদের শ্রম যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না।
শ্রম আইন ও বাস্তবতা: অনেক দেশে শ্রম আইন সংস্কার হলেও, বাস্তবে তা প্রয়োগ হয় না। বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন গঠনের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলেও, তা বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
ভবিষ্যৎ : কোন পথে শ্রমিক আন্দোলন?
শ্রমিকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে:
১. টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক অর্থনীতি: উন্নয়ন এখন আর কেবলমাত্র জিডিপি বৃদ্ধির প্রশ্ন নয়; মানবিক অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রয়োজন, যেখানে শ্রমিকের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২. প্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্তি: শ্রমিকদের নতুন প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন (upskilling) ও পুনরায় দক্ষতা অর্জন (reskilling) কর্মসূচি অত্যন্ত জরুরি।
৩. ন্যায্য বাণিজ্য ও গ্লোবাল নীতিমালা: আন্তর্জাতিক বাজারে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও মানবিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে শক্তিশালী গ্লোবাল নীতিমালা প্রয়োজন। ইন্ডাস্ট্রির সামাজিক দায়িত্ব (Corporate Social Responsibility) বাস্তব রূপ নিতে হবে।
৪. শ্রমিক সংগঠনের আধুনিকীকরণ: ঐতিহ্যবাহী শ্রমিক সংগঠনের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের শ্রমিকদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিকদের নেতৃত্বে তরুণ, শিক্ষিত প্রতিনিধি প্রয়োজন, যারা নতুন বাস্তবতায় আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।
৫. সামাজিক নিরাপত্তা: শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, অবসরকালীন পেনশন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ইত্যাদির বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
মে দিবসের মূল বার্তা — “শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার” — আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা কেবল মানবিক কর্তব্য নয়, একটি উন্নত, ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের পূর্বশর্ত। শ্রমিক শুধু উৎপাদনের একক নন, তারা সভ্যতার গতি-প্রকৃতির নির্ধারক। তাঁদের কথা না ভেবে কোনো টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের অঙ্গীকার হতে হবে — শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি মানবিক ও সমতা-ভিত্তিক বিশ্ব গড়ে তোলা।